‘‘বল, সাক্ষ্যতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় কি? বল, আল্লাহ্ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে, যেন আমি এর মাধ্যমে তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে ইহা পৌঁছবে, তাহাদের সবাইকে সতর্ক করি। তোমরা কি এই সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ্র সহিত অন্য ইলাহ্ আছে? বল, আমি সেই সাক্ষ্য দেই না, বল তিনি তো এক ইলাহ্ এবং তোমরা যে শরীক কর তা থেকে আমি অবশ্যই মুক্ত”। ___ সূরা আনআ’ম ৬:১৯।
“বাকি নামাজ বাদ অথবা দোয়া বাদ ঈমান আমলের মেহনত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা হবে, আমরা সব্বাই বসি বহুত ফায়দা হবে”,
এই আহ্বান বা ঘোষনাটি আমরা যারা নিয়মিত মস্জিদে সালাত আদায় করি তারা শুনেননি এমন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না। এ ঘোষনা বা আহ্বানটি আমাদের সবার কাছে খুবই পরিচিত। বাংলাদেশে এমন কোন মসজিদ হয়তো পাওয়া যাবে না যেখানে এই ঘোষনাটি দেয়া হয় না বা এ ঘোষনাটি দেয়ার কেউ নেই। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমাদের কোন ভাইয়েরা এ আহ্বানটি করে থাকেন? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, আমাদের খুবই পরিচিত ‘তাবলীগ জামাত’-এর ভাইয়েরা নিয়মিতভাবে এ আহ্বানটি করে থাকেন।
‘তাবলিগ জামাত’-এর ভাইয়েরা আমাদেরকে ‘ঈমান’ ‘আমলের’ ‘মেহনত’ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনার জন্য নিয়মিতভাবেই ডেকে থাকেন। আমাদের মধ্যে অনেক ভাই তাদের হালকায় বসে গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনেন, আবার অনেক ভাই কথার গুরুত্ব হয়তো বুঝেন না বলে না শুনে চলে যান।
‘তাবলীগ জামাত’-এর ভাইয়েরা যে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি মুসোল্লীদের শুনানোর জন্য মানুষকে ডাকেন তা হচ্ছে কিভাবে ‘ঈমান’ ‘আমলের’ ‘মেহনত’ করতে হয়। অর্থাৎ তাদের এই আহ্বানের আমি যে অর্থ বুঝি তা হলো, কিভাবে ঈমানের মাধ্যমে আমল বা কাজের দ্বারা মেহনত বা পরিশ্রম করে কামিয়াব বা সফলতা লাভ করা যায়। নিঃসন্দেহে তাদের এই আহ্বানটি একটি ‘আমল বিন মারুফ’ বা সৎ কাজের আহ্বান।
তাদের এই আহ্বানের বিষয় সম্পর্কে আমার মনে উদিত হওয়া কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস চালাব।
তাদের এই আহ্বানের তিনটি শব্দকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হবে। শব্দ তিনটি যথাক্রমেঃ
১) ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন।
২) আমল বা কাজ অর্থাৎ ঈমানের আলোকে ঈমানের দাবী অনুযায়ী কাজ।
৩) মেহনত বা পরিশ্রম অর্থাৎ যে কোন কাজে সফলতা লাভের জন্য পরিশ্রম অপরিহার্য।
ঈমান কাকে বলে ঈমানের সংজ্ঞা কি? এ প্রসঙ্গে একটি বহুল পরিচিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে চাই, যে হাদীসটি উম্মুল আহাদীস বা হাদীসে জিবরাঈল নামে পরিচিত।
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন; একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমতে হাযির ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে হাযির হলেন, তাঁর পোশাক ধবধবে সাদা ও মাথার চুল খুব কালো। তার শরীরের কোথাও সফরের চিহ্ন মাত্র ছিল না, অথচ আমরা কেউ তাকে চিনতে পারছিলাম না। এমন কি তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পাশে বসে গেলেন এবং তাঁর হাটু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাটুর সাথে লাগিয়ে দিলেন ও তাঁর হাত তাঁর নিজের উরুর উপর রেখে বললেনঃ হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইসলাম হল, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল বলে সাক্ষ্য দান করা, নামায কায়েম করা, রমযানের রোযা রাখা এবং সামর্থ থাকলে আল্লাহ্র ঘরের হজ্জ করা। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। ওমর (রা) বলেন, আমরা অবাক হলাম যে, আগন্তুক তাঁকে প্রশ্নও করছেন আবার তাঁর (জবাবের) সত্যায়নও করছেন।
অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঈমান হল আল্লাহ্ ও তাঁর সমস্ত ফিরিশতা, কিতাব, রাসূল, আখিরাত এবং তকদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন আপনি সত্য বলেছেন। (মুসলিম) (এই হাদীসটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ বিশেষ)
উক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যাচ্ছে, ঈমান হচ্ছে ‘আল্লাহ্ ও তাঁর সমস্ত ফিরিশতা, কিতাব অর্থাৎ আল্লাহ্তাআ’লা যে সমস্ত কিতাবাদি নাযিল করেছেন, রাসূল অর্থাৎ তিনি যত নবী রাসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, আখিরাত অর্থাৎ আল্লাহ্তাআ’লা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়ে মানুষকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন, এবং তকদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে ভাল-মন্দ যা কিছুই ঘটে তা আল্লাহ্তাআ’লার ফায়সালা, তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আল্লাহ্ কে, আল্লাহ্র পরিচয় কি? তাঁকে আমরা কেন বিশ্বাস করবো, বিশ্বাস না করলে কি হবে? একইভাবে বাকি বিষয়গুলির উপরও প্রশ্ন উথ্থাপিত হতে পারে। এই প্রশ্নগুলির উত্তর কোথায় পাওয়া যাবে এবং কে দিবেন। আল্লাহ্তাআ’লা যুগে যুগে মানুষের মধ্য থেকেই একজনকে নবী বা রাসূল নিযুক্ত করেন এবং আল্লাহ্তাআ’লা ফিরিশতার মাধ্যমে উক্ত নবী বা রাসূলের কাছে তাঁর বাণী পৌছে দেন। এই বাণীকেই বলা হয় কিতাব। এই কিতাবের মধ্যেই উপরে উল্লেখিত প্রশ্ন সমূহের জবাব পাওয়া যায়। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নবী রাসুলগণ এই কিতাব ব্যাখ্যা করে মানুষদেরকে বুঝিয়ে দেন। নবী রাসূলগণের ইন্তেকালের পর তাঁর অনুসারীরা তাঁর পক্ষ থেকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট কোন প্রকার কমবেশি না করে অর্থাৎ হুবহু পৌঁছে দেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আল্লাহ্তালার বাণী ও তাঁর রাসূলের শিক্ষা মানুষের নিকট পৌঁছে থাকে।
কোন মানুষ ঈমান আনার পর তার পরবর্তী করণীয় কি? এর উত্তর জানার আগে আমাদেরকে জানতে হবে আমরা আল্লাহ্তাআ’লার উপর, তাঁর কিতাব, নবী রাসূলগণের উপর কেন ঈমান আনলাম। একটি উদাহরন দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করছি। যারা ভিন্ন ধর্ম থেকে এসে আল্লাহ্কে স্বীকার করে নিয়ে কালিমার সাক্ষ্য দেয় তারা কি বুঝে তা করে? তারা কি আবেগ নির্ভর হয়ে তা করে থাকে, নাকি এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তার পর তারা কালিমার সাক্ষ্য দেয়? আমার দেখা মতে বেশির ভাগই জ্ঞান অর্জন করার পরই তারা কালিমার সাক্ষ্য দেন। এখন প্রশ্ন তারা কিসের জ্ঞান অর্জন করেন এবং তাদের জ্ঞান অর্জনের উৎস কি? উত্তরে বলা যায় তারা ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন যার উৎস হচ্ছে কুরআন এবং সুন্নাহ্ বা হাদীস।
যখনই কোন মানুষ ইসলামকে তার দীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহন করতে মনস্থির করে তখন কালিমার সাক্ষ্য দিয়ে মানুষ ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করে। কালেমার সাক্ষ্য ছাড়া কোন মানুষই ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
আল্লাহ্তাআ’লা বলেনঃ
“নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহ্র নিকট একমাত্র দীন”। ___ সূরা আলে ইমরান ৩:১৯।
“কেহ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহন করিতে চাহিলে তাহলে তাহা কখনও কবূল করা হইবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হইবে”। ___ সূরা আলে ইমরান ৩:৮৫।
“বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র রাসূল”। ___ সূরা আ’রাফ ৭:১৫৮।
যখনই কোন অমুসলিম ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করেন এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেন, সর্বোপরি আল্লাহ্তাআ’লা যাকে মঙ্গল দান করতে চান তার জন্য ইসলামকে বুঝা সহজ করে দেন। যেমনটা আল্লাহ্ সুবহানাহুতাআ’লা বলেন, “আল্লাহ্ কাহাকেও সৎপথে পরিচালিত করিতে চাহিলে তিনি তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করিয়া দেন এবং কাহাকেও বিপথগামী করিতে চাহিলে তিনি তাহার বক্ষকে অতিশয় সকীর্ণ করিয়া দেন”। ___ সূরা আনাম ৬:১২৫।
কোন মানুষ যখন ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে তখন তার পক্ষে ইসলামের বাইরে থাকা সম্ভব হয়ে উঠে না। যখন মানুষ বুঝতে সক্ষম হয় ইসলামই হক আর সবকিছু বাতিল তখন তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব ইসলামের বাইরে থাকা। এই জন্য পাশ্চাত্য দেশ সমূহে দেখতে পাওয়া যায়, যারা ভিন্ন ধর্ম থেকে ইসলামকে কবূল করে নিয়েছেন তারা তাদের বাকী জীবন ইসলামের প্রচার এবং প্রসারের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে গিয়েছেন। তারা যখন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তখন তারা তাদের গোষ্ঠিভুক্ত অনান্য ভাই বোনদেরকে চিরস্থায়ী ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তারা ইসলামকে এতটাই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাদের কুরআন সুন্নাহ্ সম্পর্কিত বক্তৃতা বিবৃতি শুনে গভীর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি যে, আমাদের দেশের আলিম উলামা নামধারীরা যারা সারাজীবন কুরআন সুন্নাহ্র মধ্যে ডুবে থাকেন তারাও তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। তারা কেন সক্ষম হয়নি উপরের সূরা আনাআ’মের ১২৫নং আয়াতে আল্লাহ্তাআ’লা তা বলেছেন।
আমাদের তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা যে ঈমানের দাওয়াত দেন এবং ঈমান আমলের মেহনতের কথা বলেন সেটা আসলে কি? আমরা কি মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিব নাকি ইসলামের দাওয়াত দিব? মানুষকে তো আগে জানতে হবে ইসলাম কাকে বলে, ইসলাম কি জিনিস? ইসলামকে বলা হয় দীন বা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বলতে কি বুঝায়, ইসলাম কেন পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা? ইসলাম সম্পর্কে উপরোক্ত প্রশ্নগুলি উথ্থাপন হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে বুঝার পরই কোন মানুষ মনস্থির করে সে কি ইসলামকে গ্রহন করবে, নাকি করবে না। ইসলামকে কবূল করেন নেয়ার পরই আসে শাহাদা বা সাক্ষ্য দেয়ার প্রশ্ন, যেটাকে বলা যায় ঈমান আনা। উপরে হাদীসে জিবরাঈলে ইসলাম সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার প্রথমটিই হচ্ছে আল্লাহ্কে ইলাহ্ বলে স্বীকার করা ও তার সাক্ষ্য দেয়া এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রাসূল বলে বিশ্বাস করা এবং তারও সাক্ষ্য দেয়া। ইসলামে দাখিল হওয়ার পর ইসলামের দেয়া বিধান অনুযায়ী তার উপর বিভিন্ন দায়িত্ব আরোপিত হয়। যার মধ্যে আছে সালাত কায়েম, যাকাত আদায়, রমজান মাসে সাওম পালন এবং আল্লাহ্র ঘরের হজ্জ সম্পাদন। এই পাঁচটি কাজ অর্থাৎ, ১) কালিমার [অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল] সাক্ষ্য দেয়া, ২) সালাত কায়েম ৩) যাকাত আদায়, ৪) সাওম পালন, ৫) হজ্জ পালন, হচ্ছে ইসলামের মূল স্তম্ভ বা খুঁটি যার উপর ভিত্তি করে ইসলাম দাড়িয়ে আছে।
আমাদের তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা ঈমানের আমলের মেহনত কিভাবে করেন? যদি তাদের হালকায় বসে ‘ঈমান আমলের মেহনত’ সম্পর্কে তাদের বয়ান শুনা হয়, তাহলে দেখা যাবে সুনির্দিষ্ট করে কুরআন ও হাদীস মোতাবেক তাদের কোন বক্তব্য নেই। আমভাবে আল্লাহ্, কবরের জীন্দেগি, পরকাল অর্থাৎ বেহেশত্ দোজখ সম্পর্কে কিছু বলা আর আল্লাহ্র রাস্তায় মেহনত করা অর্থাৎ চিল্লার জন্য বের হওয়া। সহিহ্ শুদ্ধ করে জামাতের সাথে সালাত(তারা নামাজ বলে) আদায় করা, ভাল করে ওজু করা, প্রশ্রাবের কোন অংশ যাতে কাপড়ে না লেগে যায় তার জন্য সাবধানতা অবলম্বনের জন্য একটু বেশি মেহনত করা, সাওম পালন, হজ্জ পালন। আরও আছে পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের কাহিনী, পূর্ববর্তী বুজুর্গদের কাহিনী, বিভিন্ন বুজুর্গ ওলী আল্লাহ্দের স্বপ্নের কাহিনী ও কারামতের বয়ানের মাধ্যমে ঈমানকে পোক্তকরণ।
কিন্তু আমরা যদি এই আমলগুলির কথা বলি এগুলিতো ইসলামের সাথে সম্পর্কিত ঈমানের সঙ্গে নয়। ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রাসূল। আমরা যে সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এ কথার তাৎপর্য কি? সাক্ষ্য মানুষ কখন দেয়? যখন কোন মানুষ কোন বিষয়ের উপর প্রতক্ষ্য সুনিশ্চিত জ্ঞান থাকে তখনই সাক্ষ্য দেয়। কোন বিষয়ের উপর যদি কারো জ্ঞান বা সেই বিষয় সম্পর্কে জানা না থাকে তাহলে তার সাক্ষ্য কি গ্রহনযোগ্য হবে? আমরা যদি দুনিয়ার জীবনেও দেখি কোন মামলায় যখন কেউ সাক্ষ্য দিতে যায় প্রথমেই সাক্ষ্যদাতাকে হলফ বা প্রতিজ্ঞা করে বলতে হয়, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না’। এখানে সত্য কথা বলতে হয় বা সত্য সাক্ষ্য দিতে হয় জ্ঞানের ভিত্তিতে, না জেনে কোন বিষয়ের সাক্ষ্য দিলে সে সাক্ষ্য মিথ্যা সাক্ষ্য বলে পরিগণিত হয়। আল্লাহ্তাআ’লা যেহেতু আমাদের মনের খবর জানেন, সুতরাং আমরা আমাদের সাক্ষের ব্যাপারে কতটুকু নিঃসন্দিহান বা কতটুকু বুঝে, উপলব্ধিতে এনে সাক্ষ্য দিচ্ছি তা কি তিনি জানেন না?
দেখুন আল্লাহ্ সুবহানাহুতাআ’লা কি বলেন,
‘‘বল, সাক্ষ্যতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় কি? বল, আল্লাহ্ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে, যেন আমি এর মাধ্যমে তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে ইহা পৌঁছবে, তাহাদের সবাইকে সতর্ক করি। তোমরা কি এই সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ্র সহিত অন্য ইলাহ্ আছে? বল, আমি সেই সাক্ষ্য দেই না, বল তিনি তো এক ইলাহ্ এবং তোমরা যে শরীক কর তা থেকে আমি অবশ্যই মুক্ত”। ___ সূরা আনআ’ম ৬:১৯।
আমরা যে বলছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এবং যার সাক্ষ্য দিয়ে ইসলামে দাখিল হচ্ছি, এখন যদি দেখা যায় আল্লাহ্ সাথে আমরা অন্যকেও ইলাহ্ সাব্যস্ত করছি তাহলে আমাদের এ সাক্ষ্য আল্লাহ্তাআ’লার কাছে কোন গ্রহনযোগ্যতা পাবে কি? পাবে না। কারণ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ নেই। এখন দিনরাত যতই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা হউক না কেন যদি আল্লাহ্ সাথে অন্য ইলাহ্ সাব্যস্ত করা হয়, জেনে হোক আর না জেনেই হোক কোন ফায়দা আছে কি?
আমাদের তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা ঈমান ও আমলের মেহনত করতে করতে কাহিল হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু তাদের বক্তব্যে এ বিষয়টির উপর কোন গুরুত্ব নেই কেন? আদৌ কি তারা এ বিষয়টি বুঝেন? যে কাজ করলে ঈমানই বাতিল হয়ে যায় সেই বাতিল ঈমানের আমল দ্বারা কি কোন ফায়দা হবে? আল্লাহ্তাআ’লার সাথে অন্য ইলাহ্ সাব্যস্ত করার এই কাজটিই হচ্ছে শির্ক। এ কথাটিই সূরা আনআ’ম-এর ১৯নং আয়াতে ফুটে উঠেছে।
তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা যে বইটি অত্যন্ত মহব্বতের সহিত বক্ষে ধারণ করে আছেন তার নাম ‘ফাজায়েলে আমল’। এ ফাজায়েলে আমল বইটি সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। বহুবার দেখানো হয়েছে ফাজায়েলে আমলের কোথায় কোথায় শির্ক রয়েছে। তারপরেও আমাদের তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা তাদের সমালোচকদের তুলোধুনা করতে ভুল করেন না স্বীকার করা তো দূরে থাক। তারা তাদের সমালোচকদেরকে তাদের শত্রু মনে করে এমন এমন মন্তব্য করে যা একজন মু’মিনের কাজ হতে পারে না। ভাই আপনি জাহান্নামে যেতে চান যান কিন্তু অন্যদেরকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছেন কেন? তারা কি দোষ করেছে?
তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা আপনারা ঈমানের জন্য কি এমন কোন আমল করছেন, যার কারণে আপনাদের মেহনত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে? আপনারা মানুষকে ডাকছেন কল্যাণের দিকে, আপনারা মানুষকে ডাকছেন আল্লাহ্র দিকে। আপনারা মানুষকে বিশেষ করে মুসলিমদেরকে ডাকছেন যাতে করে সে তার আমল দ্বারা জান্নাত হাসিল করতে পারে। আপনারা এক কথায় মানুষকে জান্নাতমুখী করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি একটি উত্তম কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাহুতাআ’লা যে বলেন, “যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং তাহাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করে নাই, নিরাপত্তা তাহাদেরই জন্য এবং তাহারাই সৎপথ প্রাপ্ত”। ___ সূরা আনআ’ম ৬:৮২।
তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা কখনো কি যাচাই করে দেখেছেন, যে আপনাদের ঈমান যুল্ম দ্বারা কলুষিত কিনা? যদি না হয়ে থাকে তো আল্হামদুলিল্লাহ্, কিন্তু যদি হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্র কথা অনুযায়ী আপনারা পথভ্রষ্ট এবং আপনাদের জন্য কোন নিরাপত্তা নেই। ঈমানের সাথে যুল্মের মিশ্রন কাকে বলে, ঈমানের সাথে যুল্মের মিশ্রন কিভাবে ঘটে সেটা জেনে আপনারা আগে নিশ্চিত হোন। সুতরাং আপনারা আগে নিজেদের ঈমানের হালত সম্পর্কে খোজ খবর নিন, তারপরে অন্যদেরকে ডাকুন। অন্যেরা আপনাদের ঈমানের সঙ্গে যুল্মের মিশ্রন সম্পর্কে সতর্ক করলে তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় প্রবৃত্ত না হয়ে কুরআন হাদীস বুঝে পড়ুন, নিরপেক্ষ মন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন। নিজের বিবেক বুদ্ধিকে একমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আর কারো কাছে বন্ধক দিবেন না। আল্লাহ্তাআ’লা বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন কাজে লাগানোর জন্য বন্ধক দেয়ার জন্য নয়। আপনাদের বিবেক-বুদ্ধি যদি কারো কাছে বন্ধক দিয়ে থাকেন তাহলে তা ফিরিয়ে আনুন। বন্ধক দেওয়া বিবেক-বুদ্ধি ফিরিয়ে আনা না পর্যন্ত আপনারা অন্ধের মত শুধু পথই হাতড়ে মরবেন আর কোনই লাভ হবে না।
ফায়দার প্রতি লোভ রাখবেন না। নেক আমল করলে ফায়দা অবশ্যই হবে। শয়তান কায়দা করে অনেককেই ফায়দা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে। যেমন আমাদের আদি পিতা হযরত আদম(আ)-কে শয়তান বেহেশ্ত পাওয়ার ফায়দা দেখিয়েই কিন্তু নিষিদ্ধ গাছটির ফল খেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই পৃথিবী যত প্রকার প্রতারণা হয়, প্রতারকরা কিন্তু বলে না যে, সে প্রতারণা করার মিশন নিয়ে আপনার কাছে এসেছে। সে আপনার কাছে আসবে আপনার শুভাকাঙ্খী বন্ধুরূপে। যেমনটা এসেছিল ডেসটিনি, ইউনিপেটু, যুবক ইত্যাদিরা, ফলাফল আমাদের সবারই জানা। দুনিয়ার প্রতারকরা মানুষকে শুধু দুনিয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ করে। কিন্তু ধর্মীয় প্রতারকরা দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ করে।
এ লেখাটা শেষ পর্যায়ে রেখে মাগরিবের সালাত আদায় করতে মসজিদে যাই। ফরয সালাত শেষে তাবলীগ জামাতের এক ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঈমান সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এই ঈমানই যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে থাকে কি। আমলের দ্বারা মেহনত করে ঈমানকে ঠিক রাখতে হবে। বাকি নামাজ বাদ ঈমান আমলের মেহনত……… বহুত ফায়দা হবে”।
কথাতো ঠিক কিন্তু কাজটি বেঠিক। কারণ আগে প্রকৃত ঈমান সম্পর্কে জানুন তারপর সেই অনুযায়ী ঈমান এনে আমল করার জন্য মেহনত করুন। তা না হলে সবই পন্ড।
আল্লাহ্তাআ’লা বলেনঃ
“বল, আমি কি তোমাদিগকে সংবাদ দিব কর্মে বিশেষ ক্ষতি গ্রস্থদের? উহারাই তাহারা, পার্থিব জীবনে যাহাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তাহারা মনে করে যে, তাহারা সৎকর্মই করিতেছ”। ___ সূরা কাহ্ফ ১৮:১০৩-১০৪।
আল্লাহ্র দরবাবের গ্রহনযোগ্য নয়, এমন ঈমান নিয়ে যতই আমল করা হউক, সে আমলের জন্য যতই মেহনত করা হোক কোন ফায়দা হবে কি?